ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত
ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা গত ১৫ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১১ টায় সিলেট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা, বিগত সরকারের আমলে ঘোষিত সকল মজুরি পূন:নির্ধারণ , গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সর্বাত্নক রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বিভিন্ন বেসিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি সুখেন্দু তালুকদার মিন্টুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস এবং প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক শ্রমিকনেতা রফিকুল ইসলাম।
ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেট জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. ছাদেক মিয়ার পরিচালনায় অনুষ্ঠিত প্রতিনিধি সভায় ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট বিভাগে অর্ন্তভূক্ত ২০ টিরও বেশি বেসিক সেক্টরের শতাধিক প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম ছদরুল, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) সিলেট জেলা কমিটির দপ্তর সম্পাদক রমজান আলী পটু, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহিন মিয়া, সুনামগঞ্জ জেলা বারকি শ্রমিক সংঘের সভাপতি নাছির মিয়া, চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হরিনারায়ন হাজরা, জুড়ী উপজেলা রাইস মিল শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহিদ আহমেদ, সিলেট জেলা স’মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন, সুনামগঞ্জ হকার্স শ্রমিক সংঘের নেতা আব্দুল হাই, দিরাই উপজেলা নির্মাণ শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক প্রাণনাথ রায়, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ শাহপরান থানা কমিটির সভাপতি ও পরিবহণ শ্রমিকনেতা খোকন আহমেদ, জুড়ী উপজেলা ডেকোরেটার্স শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক মোঃ সেলিম আহমদ, নারী চা-শ্রমিকনেত্রী লক্ষী রানী বাক্তি, সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা আব্দুল মুমিন রাজু, সুনামগঞ্জ স’মিল শ্রমিক সংঘ সভাপতি সিরাজ উদ্দিন, জুড়ী হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল করিম, শ্রীমঙ্গল উপজেলা স’মিল শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান, সুনামগঞ্জ জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা বদিউজ্জামান বদরুল, মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: সুহেল মিয়া, জাতীয় ছাত্রদল সিলেট জেলা কমিটির আহবায়ক শুভ আজাদ (শান্ত), হোটেল শ্রমিকনেতা আবুল কালাম, বারকি শ্রমিকনেতা ফদির মিয়া, নির্মাণ শ্রমিকনেতা রাজু মন্ডল, নুরুল আমিন প্রমূখ।
প্রতিনিধি সভায় বক্তারা বলেন বর্তমানে দেশের শ্রমিক ও শ্রমজীবী নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতিতে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে শ্রমিক কৃষক জনগণের শ্রমে-ঘামে যে উদ্ধত্ত সৃষ্টি হয় তার সিংহভাগই লুটপাট করে নেয় সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দালাল জোতদার-মহাজন, দুর্নীতিবাজ আমলারা। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের শীর্ষ নেতারাই এই লুটপাটের সাথে জড়িত থাকে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও শ্রমিক-কৃষক-জনগণের মুক্তি আসেনি। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান না ঘটায় জনগণ যে তিমিরে ছিল সেই তি মিরেই রয়েছে। গত নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর হাতে যেমন গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রাণ দিতে হয়েছে তেমনি বর্তমান অন্তবর্তকালীন সরকারের হাতেও পুলিশের গুলিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে। আজ তিন মাস যাবত সরকারি মালিকানাধীন এনটিসির ১২ টি চা-বাগানের প্রায় ১২ হাজার চা-শ্রমিক মজুরি-রেশন থেকে বঞ্চিত, অথচ সরকার নির্বিকার। বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লুটপাটের মহাউৎসবে মিলিত হয়েছিল ঠিক অনুরূপভাবে বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদের দালাল অন্যান্য বিরোধী দলগুলো সেই লুটপাটের মহাউৎসবে মিলিত হয়েছে। বিগত সময়গুলোতে বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য দলগুলো লোকদেখানো জনগণের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বললেও বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিসহ জাতীয় ও জনগণের জরুরী সমস্যা নিয়ে তারা নিরব।
সভায় বক্তারা আরও বলেন সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা এক গভীর ও সামগ্রিক সংকট, দ্বদ্ব-সংঘাতময় এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, আঞ্চলিক ও স্থানিক যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। বিশ্ব বাজার পুনর্বন্টন নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যে যুদ্ধ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়ে ধারাবাহিক তৎপরতা চালাচ্ছে তারই প্রতিফলন ঘটছে ইউক্রেনে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে। এই যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্ব গঠিত সামরিক জোট ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ নীতি মোকাবেলা করে রাশিয়ার স্বীয় লক্ষ্য হাসিল করা। অন্যদিকে তাইওয়ান স্বাধীনতার ইস্যু নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহত সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্যে অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীনের মুখোমুখি অবস্থান ও তাইওয়ান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তাকে চীনের রেড লাইন ঘোষণা বিশ্ব পরিস্থিতিকে উত্তেজনাকর করে তুলেছে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদীরা জোরদার করছে সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতিকে। তাদের এই যুদ্ধ প্রস্তুতি থেকে আমাদের দেশও মুক্ত নয়। ভ‚-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশকে নিয়েও আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব সুতীব্র। সাম্প্রতিক দেশের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পিছনেও রয়েছে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান আরও অগ্রসর হয়। সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটলেও বিদ্যমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তাই বিদ্যমান নয়াউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী সমাজ কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে সাম্রাজ্যবাদের এক দালালের পরিবর্তে আরেক দালাল বা এক সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে আরেক সাম্রাজ্যবাদের দালাল ক্ষমতাসীন হলেও জনগণের কোন মৌলিক পরিবর্তন হবে না। তাই সকল সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে বেগবান করে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের সামগ্রিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।
সভা থেকে অনতিবিলম্বে সকল বন্ধ কল-কারখানা চালু, রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে দলীয় তোষণনীতির ভিত্তিতে গঠিত অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলসহ শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সকল কালো আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করে, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন করা, সভা-সমাবেশ-ধর্মঘট এবং অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা, অবিলম্বে এনটিসির বাগানসহ সকল চা-বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি-রেশন পরিশোধ, হোটেল রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা এবং অনতিবিলম্বে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের গঠিত মজুরি বোর্ড বাতিল করে যথাযথ শ্রমিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে মজুরি বোর্ড গঠন করে বাজারদরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের দাবি জানান।